গরীব কেন গরীব থাকে?

Image result for economics

(এক)
আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক একবার একটি কথা বলেছিলেন, "গরীব কেন গরীব থাকে? ফুটানি করতে করতে গিয়ে।"
এই সত্য কথাটাকে আমি আমার মতো করে ব্যাখ্যা করছি। আমরা যারা অর্থনীতি পড়েছি। আমরা জেনেছি, যে দেশ বিনিয়োগে অর্থ বেশি দেয়, সেই দেশ এগিয়ে যায়। আর যেই দেশ ভোগের পিছে বেশি অর্থ ব্যয় করে সেই দেশ পিছিয়ে পড়ে। এটা Macroeconomic এর বিষয় হলেও, ব্যাক্তি জীবনেও এর প্রতিফলন দেখা যায়।
বিষয়টা ক্লিয়ার করার জন্যে আমি কিছু উদাহরণ দিচ্ছি।
আপনি চলে যান ফ্যান্টাসি কিংডমে, ওয়াটার ওয়ার্ল্ডে এসব জায়গায়। দেখবেন ৭৫% এসেছে গরীব ফ্যামিলি থেকে। এদেরই মধ্যে বড় একটা অংশ পাবেন যারা এসেছে একাধিকার।
এইতো কয়েকমাস আগে, একটি মুভি রিলিজ পেলো, নাম "আয়নাবাজি"। আমার পরিচিত, সে বাড্ডায় থাকে। বেশ পয়সাওয়ালা। সে এই মুভিটা দেখলো মধুমিতায়। ১২০ টাকা টিকিট কেটে। আরেকজনকে চিনি, সে খুব অর্থকস্টে আছে। সেও মুভিটা দেখলো। কোথায় দেখলো? তিনশটাকায় টিকিট কেটে বসুন্ধরায়।
আপনি নিশ্চিন্তে থাকেন, এই গরীব লোকটা বসুন্ধরায় বাসে যায়নি। গেছে সিএনজিতে। কারন এই ধরনের গরীব লোকগুলো পাচ মিনিটের হাটা পথও রিক্সায় চড়ে যায়।
অথচ আমি এমনও দেখেছি, পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলে, মাইলের পর মাইল হেটে কলেজে যেতে।
আমার এক স্কুল ফ্রেন্ড। সে বলতো, "একশ টাকার নীচে কি মোবাইলে ভরা যায়? আমার একটা প্রেস্টিজ আছেনা?" সে মোবাইলে তিন চারশ টাকা ভরতো আর ইচ্ছেমত খরচ করতো। আমার সেই বন্ধুটি এখন অর্থকস্টে দিন পার করছে।
আমার আরেক বন্ধু, তার কাছে টাকা থাকা সত্বেও মোবাইলে ভরতো দশ টাকা। আজ তার একটা পেট্রলপাম্প আছে।
যারা এমন ফুটানি করে, বরিশালের ভাষায় এসব গরীব অপচয়কারীদের খুব মজার নামে ডাকা হয় "ফুডারপো ফুডা!"
আমাদের সমাজে এইসব ফুডারপো ফুডাদের কারনে দিনকেদিন শক্তিশালী হচ্ছে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্য।
আমাদের এই মনমানসিকতা আমরা বুঝতে না পারলেও, বুঝতে পারছে পুঁজিবাদীরা। যা তাদের বিজ্ঞাপন দেখলেই বোঝা যায়। একটি বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, মেয়ে তার বাবা-মাকে নিয়ে ফাইভ স্টারে খেতে গেছে। "নতুন বেতন পাইছি মা, লেটস সেলিব্রেট!!"
(দুই)
আসলে একটি বড় অংশের গরীব কেন এই অপচয়ের চক্রে জড়িয়ে পড়ছে। অর্থনীতি আর মনোবিজ্ঞান এর আলোকে একটি ছোট অনুমান আমি সাজিয়েছি।
এই গরীব অপচয়কারীদের ঘাটলে দেখা যায়, এরা অধিকাংশ এসেছে চাকুরীজীবী ফ্যামিলি থেকে। চাকুরীজীবীদের যদি ঝুকি গ্রহনের মনমানসিকতা থাকতো তাহলে তারা ব্যবসাই করতো। চাকুরী তারা করতো করতো না।
কিন্তু যেহেতু ঝুকি গ্রহনের মনমানসিকতা তাদের নেই। তারা বেছে নেয় চাকুরী নামের একটি নিরাপত্তামুলক পেশাকে। প্রজেক্ট সফল হোক বা ব্যর্থ বেতন তারা পাবেই। এই বেতনের টাকা দিয়ে তারা কি করছে। তারা জমাচ্ছে, তারা সঞ্চয় করছে। চেস্টা করে যাচ্ছে সঞ্চয়ের টাকাটাকে ব্যাংকের চক্রবৃদ্ধির মাধ্যেমে বাড়াতে। এই টাকার একটি সিংহভাগ এরা খরচ করে ছেলে অথবা মেয়ের বিয়েতে। বিয়েতে কি হয়, খাও দাও ফুর্তি করো। অর্থাৎ ভোগ। সবাই মিলে বিশাল একটা ভোগ।
একজন চাকুরীজীবী এর সন্তানের বিয়ের প্রোগ্রাম এবং একজন ব্যবসায়ীর সন্তানের বিয়ের প্রোগ্রাম কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক হয়না। বিয়ের প্রোগ্রাম মানে বেশ বড় একটি প্রজেক্ট। ধরুন,একজন চাকুরীজীবী ১০০ টাকা খরচ করলে সে সেখান থেকে ৮০ ইউনিট কাজ আদায় করতে পারে। অপরদিকে একজন ব্যবসায়ী সে জানে কিভাবে রিস্ক নিতে হয়, কিভাবে টাকাকে ব্যবহার করে টাকাকে টাকা বানাতে হয়। একজন ব্যবসায়ী ১০০ টাকা খরচ করলে, সে অন্তত ১৩০ ইউনিট কাজ আদায় করতে পারে।
একজন চাকুরীজীবী যখন তার সন্তানের বিয়ের প্রোগ্রাম করেন, তখন সেটা ১০০% হয় বিয়ের প্রোগ্রাম। সেই চাকুরীজীবীর মাথায় একটা চিন্তাই থাকে বরপক্ষকে নিয়ে। বরপক্ষ খুশি হলো কিনা, ঠিকমতো খেলো কিনা।
অপরদিকে একজন ব্যবসায়ী যখন তার সন্তানের বিয়ের প্রোগ্রাম হয়। তখন সেটা শুধু বিয়ের প্রোগ্রামই থাকেনা, সেটা রুপ নেয় বিজনেস পার্টিতে। সেই ব্যবসায়ী এমন এমন মানুষকে ইনভাইট করে,যারা প্রোগ্রামে আসলে ব্যবসায়ের জন্যে সুবিধা হবে। এখনে তেমন অনেকেই আসেন, বিয়ের অনুষ্ঠানের ফাকে হয়ে যায় গুরুত্বপূর্ণ বিজনেস আলাপ। অনেকে চুক্তির বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা করেন।
আপনারা অনেকেই Mario Puzzo এর GOD FATHER উপন্যাসটা পড়েছেন। এই উপন্যাসের প্রথমদিকে দেখা যায় ডন ভিটো কার্লিওনির মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। মেয়ের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার দিকে তার খুব একটা মনোযোগ নেই। বিয়ের প্রোগ্রাম উপলক্ষে অনেক গন্যমান্য ব্যক্তিরা এসেছেন। তাদের নিয়ে দরকারি একাধিক মিটিং করে ফেললেন, একটা বিচারও করে ফেললেন।
বিদেশের কথা বাদ দেন। আমি আমার কথাই বলি। আমার ভাইয়ের যখন বিয়ে হয়, বরযাত্রী চিটাগাং যাবে ঢাকা থেকে। আমি আমার ব্যাংকার বন্ধুদের বরযাত্রীতে দাওয়াত দেইনি। কারন এসব ব্যাংকার আমার কি কাজে আসবে। আমি আমার আব্বা দাওয়াত দিয়েছি আমাদের ব্যবসায়ী বন্ধুদের। মহল্লার গন্যমান্যদের যাদের সাথে সুসম্পর্ক থাকলে আমাদের ব্যবসায়ে লাভ। অবশ্যই আমাদের সিদ্ধান্ত সুদুরপ্রসারী ছিলো।
অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি, একজন ব্যবসায়ী বিয়ের প্রোগ্রামের আয়োজন করলে সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয় বিনিয়োগ। যার একটা অংশ ব্যবসায়ী ভবিষ্যৎ এ তুলে নিতে পারে। অপরদিকে একজন চাকুরীজীবী বিয়ের প্রোগ্রামের আয়োজন করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয়ে যায় ভোগ। যা তারা তুলতে তো পারেই না। উল্টো সেই চাকুরীজীবীর সংসারে অভাব নেমে আসে।
তাই চাকুরীজীবী প্রজন্মের কিছু ছেলে মেয়েরা ছোটবেলা থেকেই ভোগের জন্যে খরচের জিনিস দেখতে দেখতে ওদের ব্রেনে ভোগ গেথে যায়। বিনিয়োগ এর চিত্র, বিনিয়োগের জন্যে সংগ্রাম, বিনিয়োগের জন্যে ঝুকি গ্রহনের মানসিকতা এসব তারা দেখেনা। এসবে তারা অভ্যস্থও হয়ে উঠতে পারেনা।
এসব ছেলে মেয়েদের জীবন দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা এইরকম, "খাও দাও ফুর্তি করো, আর চাকুরী খোজো।"
এরা গরীব থেকে আরোও গরীব হয়। আর দোষ দেয় আল্লাহকে, "আল্লাহ তুমি কি দেখোনা, আমারে ট্যাকা দাওনা ক্যান?"
আল্লাহর কি এমন ঠ্যাকা পড়েছে, যে সে আপনাকে টাকা দেবে। আপনাকে টাকা দিলেতো ফুটানি করে টাকা উড়াবেন। যাকে দিলে দশজন মানুষ উপকার পাবে,আল্লাহ তাকে টাকা দেবে।
ফুটানি যে কি পরিমান হতে পারে, শুনলে চোখ মাথায় উঠবে। বিদেশে এক ছেলে কিডনি বিক্রি করেছে। কিসের জন্যে? স্মার্ট ফোন কেনার জন্যে।
এক বর ২০০৯ সালে হেলিকপ্টারে করে, বউ তুলে নিয়ে আসলো। সেই বরের পরিচয় কি? একটি গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক।
গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যান। দেখবেন ওখানকার ছেলে মেয়েদের হাতে আপনার চেয়েও উচ্চপ্রযুক্তির মোবাইল সেটে ইন্টারনেট ইউজ করছে। খোজ নিয়ে জানলেন, থাকে বেড়ার ঘরে। কিন্তু ঠিকমতো খেতেও পারেনা। আপনি হয়তো তৃপ্তির ঢেকুর তুললেন,যাক প্রযুক্তির উন্নতিতে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আরোও খোজ নেন, জানতে পারবেন, এরা ইন্টারনেটে কাজের কাজ কিছুই করেনা, হয় চ্যাটিং, নয়তো ইন্টারনেট গেমে আসক্ত অথবা হাবিজাবি ভিডিও দেখে, নয়তো ফেসবুকে ছ্যাকামারা পোস্ট দেয়, "তোমারে ছাড়া বাচুম না।" এদের ফেসবুক আইডির নাম গুলো আরোও অদ্ভুত Maruf Alone Boy/ কস্টে ভরা জীবন/ Angel উমুক/ Angel তমুক/ ডানা ওয়ালা পরী ব্লা ব্লা ব্লা। এরা এমবি কিনে এমন পোস্ট দেয়, যেন প্রেমই জীবন,প্রেমই মরণ।


(তিন)
আমার লেখা পড়ে ভুল বুঝবেন না। আমি গরীবদের বিপক্ষে নই। একসময় আমরাও বেশ অর্থকস্টে ছিলাম। আমি আর আমার ভাই একসাথে S.S.C দেই। আমরা একটা বইকে অধ্যায় ভাগ করে দশ টুকরো করে পড়তাম। আমি যখন চ্যাপ্টার এক পড়তাম, আমার ভাই হয়তো পড়তো চ্যাপ্টার তিন। এছাড়া আরোও বইয়ের প্রয়োজনে সদরঘাটের পুরানো বইয়ের দোকান থেকে বই কিনতাম। আমার ভাই ক্লাশ নাইন থেকেই টিউশনি করতো। যা বেতন পেত আম্মার হাতে দিত। নতুন শার্টও কিনতো না। আমার ভাইবোন আমি আমরাও টিউশনি করতাম। আমরা ভাইবোনরা গরিব থাকলেও ফুটানি করিনি। আজ আমাদের অবস্থানটা কোথায়। আমার সেই ভাই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস করে এখন সে বিসিএস ক্যাডার। এসসিপিএস করছে।
আমার বোন একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান।
আর আমি একজন উদ্যেক্তা।
আমাদের ভিতর কিন্তু এখনো ফুটানি নেই। আমি আমার ভাইবোন আমাদের বেশভূষা খুবই সিম্পল।
ওরা কিন্তু নিয়মিত দান করে।
ফুটানি করে বেশিদুর যেতে পারবেন না। টাকাটা ভালো কাজে লাগান। ভালো একটা বই কিনতে পারেন, অথবা টাকাটা বাবা-মা এর হাতে তুলে দেন। গরীব বাপ-মা কে চাপ দিয়ে, গলায় পাড়া দিয়ে টাকা উঠাবেন। আর সেই টাকা দিয়ে বন্ধুবান্ধব নিয়ে মাস্তি করবেন। তাহলে কখনই সুখী হতে পারবেন না।
ফুটানি বাদ দিয়ে বিনিয়োগে যেন আপনার সন্তান অভ্যস্ত হয়, আপনার সন্তানকে সেই শিক্ষাই দিন।
বিল গেটসের একটি উক্তি দিয়ে লেখাটি শেষ করছি, "If you born poor it's not your mistake, but if you die poor it's your mistake."

ধন্যবাদ।
----------------------
তাজুল ইসলাম মাসুদ,
৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৬,
শুক্রবার।
ঢাকা, বাংলাদেশ।

You can like on my facebook page.
facebook.com/tazulislammasud

Comments

Popular posts from this blog

পথে নামলে পথই পথ দেখায়

মাওলানা ছায়ীদুল হকের আরেকটি পরিচয়

ক্যারিয়ার বান্ধব মেডিটেশন মনছবি