ফিতরত

 


(ভূমিকা)
কয়েকদিন আগে একজন প্রজ্ঞাবান ব্যাক্তির সাথে প্রায় আট ঘন্টার মতো ছিলাম। সেই প্রজ্ঞাবান ব্যাক্তি এমন একটি বিষয়ের উপরে কিছু মুল্যবান কিছু আলোচনা করলেন, যা আমাকে মুগ্ধ করলো। বিষয়টা ছিলো "ফিতরত"। আসলে কি এই "ফিতরত"? শব্দটা অনেকের জন্যেই নতুন। আমি ক্লিয়ার করে দিচ্ছি।
উনার আলোচনার অবলম্বনে আমি নিচের লেখাটা লিখলাম। আমি লেখাটা এমনভাবে তুলে ধরছি, যাতে করে সবাই বুঝতে পারে।
তবে যারা আত্মীকভাবে নিজের আরোও উন্নতি চান, লেখাটা পড়ে তারাও উপকৃত হবেন।

(এক)
ফিতরত কি? স্রস্টার সৃষ্টি এই প্রকৃতি। প্রকৃতির আইন হচ্ছে "ফিতরত"। মানুষের স্বভাব ধর্ম হচ্ছে ফিতরত।
একটা বাচ্চা যখন জন্মগ্রহণ করে। ছোট বাচ্চাকে বুঝাতে হয়না কিভাবে খেতে হয়। সে মুখ দিয়েই খায়। সে নাক দিয়ে খাবার চেষ্টা করেনা। এটা তার ফিতরত। এটা তার স্বভাব। অর্থাৎ প্রকৃতি যে নিয়ম করেছে, সেই নিয়মটা হচ্ছে ফিতরত।
একজন মানুষ জন্মগ্রহণ করে সমর্পিত হয়ে, এটা তার ফিতরত। তার জীবনে দুঃখকষ্ট আসেনা। দুঃখকষ্ট থেকে মুক্ত থাকে। তবে নিয়মের বাইরে গেলে দুঃখকষ্ট আসে।
হযরত আদম আঃ খুব সুখেই ছিলেন। যখনই নিয়মের বাইরে গেলেন। নিয়ম ভঙ্গ করলেন, নির্দেশ লঙ্ঘন করলেন দুঃখকষ্ট তাদের জীবনে আসলো।
প্রত্যেকটা মানুষ যেহেতু সমর্পিত হয়ে জন্মগ্রহণ করে, সমর্পণটা তার জীবনের ফিতরত।
এই ফিতরত থেকে দূরে সড়ে গেলেই অশান্তি। যত দূরে সরে যাবেন ততই অশান্তি, দুঃখকষ্ট এবং অশান্তির আগুনে পুড়বেন। আগুন বলতে শুধু আমরা জাহান্নামের আগুনকেই বুঝি। কিন্তু দুনিয়ার অশান্তির আগুনও অনেক পীড়া দেয়।
(দুই)
শয়তানের কাজ কি?
শয়তানের কাজ হচ্ছে, স্বভাবধর্ম অর্থাৎ ফিতরত থেকে আপনাকে দূরে সরানো।
স্বভাব ধর্ম অর্থাৎ ফিতরতে থাকলে শান্তিতে থাকবেন। দূরে সরে গেলে অশান্তির আগুন।
এইযে যখন আপনারা এখানে ধ্যানমগ্ন ছিলেন, ফিতরতে ছিলেন। বিরতিতে যখন নীচে গেলেন। পারিপার্শ্বিক কারনে আপনি ফিতরত থেকে কিছুটা সরে গেলেন। এভাবে পারিপার্শ্বিকতায় আমাদের অন্তরে দাগ অর্থাৎ মোহর লাগতে থাকে। এভাবে দাগ পড়তে পড়তে আমাদের সাদা অন্তর একদম কালো হয়ে যায়। কোনটা সঠিক কোনটাভুল বুঝতে পারিনা। আমরা বিচ্যুত হই আমাদের স্বভাব ধর্ম অর্থাৎ ফিতরত থেকে। বিচ্যুত হই সমর্পিত জীবন থেকে।
একটি ঘটনা বলছি, অন্তরের মোহরের বিষয়টা পরিষ্কারভাবে বুঝানোর জন্যে।
কিছু স্বেচ্ছাসেবক মানুষ পরিচ্ছন্নতার কাজ করেন। তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বাথরুম টয়লেট পরিষ্কার করেন। এই স্বেচ্ছাসেবক দলের অধিকাংশই শিক্ষিত এবং স্বচ্ছল ফ্যামিলি থেকে আসা। এই পরিচ্ছন্নতার কাজ তারা করছেন কারন এতে মনের অপরিচ্ছনা দূর হয়, মনের ভিতর থেকে অহম দূর হয়।
যাইহোক এক স্বেচ্ছাসেবক দল একটি কলেজে গিয়ে দেখলেন, কালো কমোড। সেই কলেজের শিক্ষক বললেন, কমোডটা কালোই। কারন উনি যখন স্কুলে জয়েন করেছেন, তখন থেকে উনি ওটাকে কালোই দেখেছেন। কিন্তু স্বেচ্ছাসেবক টিম সেই কমোডকে ভালোভাবে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করতে লাগলেন। কমোডটা সাদা হয়ে গেলো। ফিরে পেলো কমোডের আসল সাদা রঙ।
ফিতরত থেকে সরে যাবার কারনে, আমাদের অন্তরের অবস্থা হয়ে পড়ে অনেকটা সেই কমোডের মতই।
আমরা যখন জন্মগ্রহণ করি সমর্পিত হিসেবেই জন্মগ্রহণ করি, এরপর পারিপার্শ্বিক কারনে বেড়ে ওঠার সাথে সাথে আমাদের অন্তরে দাগ পড়তে থাকে, আস্তে আস্তে নিজেদের অজান্তেই সরে আসতে থাকি আমাদের সমর্পিত স্বভাব থেকে, আমাদের প্রকৃত ফিতরত থেকে। মোহর পড়তে পড়তে আমাদের অন্তর সেই কমোডের মতো কালো হয়ে যায়, আমরা ভুলেই যাই যে এটা সাদা ছিলো।
(তিন)
এখন এই ফিতরত ঠিক রাখতে হলে আমাদের লক্ষ্যটাকে ঠিক রাখতে হবে।
সুরা বাকারার ১৪৮ নং আয়াতে আছে, "প্রত্যেকেরই একটি লক্ষ্য আছে; যা তার কর্মধারাকে পরিচালনা করে।"
যেকোনো কিছু অর্জনের জন্যে লক্ষ্য পরিস্কার থাকলে বিভ্রান্ত হওয়া সম্ভব না।
লক্ষ্যটা যখন স্বভাব ধর্মের অনুকুলে হবে, তখন প্রকৃতির স্পন্দনের সাথে আমাদের স্পন্দন সহজ হবে।
আমাদের লক্ষ্যটা কি হওয়া উচিৎ, সেটা কোরয়ানেই স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
"হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা পুরোপুরি সমর্পিত না হয়ে মারা যেওনা।"
-আলে-ইমরান: ১৫৬
সুতরাং সার্বক্ষণিক সমর্পিত থাকা, আর সমর্পিত হয়ে মৃত্যুর নির্দেশ কোরয়ানেই আছে। অর্থাৎ এটাই আমাদের মুল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ এবং এই লক্ষ্যই আমাদের ফিতরতের ১০০% অনুকুলে। এই লক্ষ্য আপনার ভিতরে স্পষ্ট থাকলে, আপনার ভিতরে গেঁথে গেলে। আপনি ফিতরতের ভিতরেই থাকবেন। স্বভাবধর্মবশত আপনি প্রতিনিয়ত বিশ্বাসী হয়ে সৎকর্ম করে যেতে থাকবেন। অকাজ-কুকাজ, অপ্রয়োজনীয় কাজ আসলে আপনার ভিতর থেকেই মেসেজ পাবেন, এই কাজটা আপনার লক্ষ্যের জন্যে ঠিক নয়, তখন সাথে সাথে সেই কাজ থেকে বিরত থাকার শক্তি পাবেন, বিরত থাকবেন, অর্থাৎ আপনি আপনার ফিতরতের মধ্যেই থাকলেন।
এতক্ষন সময় নিয়ে লেখাটা পড়ার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।
আমার জন্যে দোয়া করবেন, যেন আমিই ফিতরত থেকে সড়ে না যাই।
-------------------------
তাজুল ইসলাম মাসুদ,
১৯ মে, ২০১৭.
ঢাকা, বাংলাদেশ।

 

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

পথে নামলে পথই পথ দেখায়

মাওলানা ছায়ীদুল হকের আরেকটি পরিচয়

ক্যারিয়ার বান্ধব মেডিটেশন মনছবি