সকালের পাখি (টাইম ম্যানেজমেন্ট পর্ব ১)

Image result for morning bird

 

সকালের পাখি

==============

তাজুল ইসলাম মাসুদ
(এক)
আমি স্কুল জীবনে পড়াশুনায় খুব একটা মনোযোগী ছিলাম না। আমি দাবা খেলায় সময় দিতাম। স্কুল জীবনেই পল্টনের জাতীয় ক্রিড়া কক্ষে আমার ছিলো নিয়মিত আসাযাওয়া। বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন এর অনুর্ধ ১৬ এর দাবা খেলোয়াড় ছিলাম। দাবা ফেডারেশনে নিয়মিত আসতেন উপমহাদেশের প্রথম গ্রান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ। এতবড় সেলিব্রেটি অথচ খুব সাধারণ চলাচল। আমার ছোটবোন, তখন ওর বয়স ছয়সাত হবে। ও জীবনের প্রথম অটোগ্রাফ নেয় তখন নিয়াজ মোর্শেদের কাছ থেকে। নিয়াজ মোর্শেদ উনিও কখনো কখনো প্রশিক্ষণ দিতেন। আমি যখন স্কুলে যেতাম, ক্ষুদে দাবাড়ু হিসেবেও স্যার ম্যাডাম এমনকি অনেক ছাত্রছাত্রীর কাছে বেশ গুরুত্ব পেতাম। অনেক শিক্ষক আমাকে বাসায় ইনভাইট করতেন, যেন বাসায় গিয়ে দাবা খেলি তার সাথে। স্যারদের হারাতাম। কখনও স্যারেরা ভুল চাল দিলে ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করতো। হতেপারেন উনি শিক্ষক, কিন্তু এখানে উনি আমার দাবার প্রতিযোগী। আমি চাল ফেরত নিতে দিতাম না।
স্কুলে খুব কমই যেতাম, যখন যেতাম ক্লাসের করিডর দিয়ে যখন হাটতাম, অন্যক্লাসের সিনিয়র জুনিয়র ছাত্ররা দেখতো আর বলতো, "ওইযে তাজুল, দাবাড়ু তাজুল।"
আবার যখন হারতাম টিটকারিও শুনতাম, "হারছে! বাদ পড়ছে! পেপারে দেখছি ঠকছে! পারে নাই!"
ভালোমন্দ সবই ইঞ্জয় করতাম।
আমি দাবা ভালো খেলতে পারতাম, কিন্তু ক্লাস নাইনে ওঠার পর দাবা খেলা আর ভালো লাগতো না। খুবই বিরক্তিকর মনে হতো। ওইসময়ই গ্রান্ড মাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ একটি কথা বলেছিলেন, "দাবার চেয়ে জীবন বড়।"
চৌষট্টি ছকের ভিতরে নিজেকে বন্দি রাখতে চাইলাম না। ক্লাস টেন এ উঠে দাবা খেলা বাদ দিয়ে দিলাম। মনোযোগী হলাম S.S.C এর প্রস্ততি নিয়ে। দাবার জীবনের এসব কথা আমার এখন তেমন মনে পড়েনা। তবে তখনকার একটা কথা আজও মনেপড়ে। যা কখনওই ভুলবো না। একটা প্রশিক্ষণের সময় একজন কোচের একটা খুব সাধারণ কথা আমার এখনো মনে আছে। উনি বলেছিলেন, "দাবার বোর্ডের মাঝের যে চারটা ঘর, এই চারটা ঘর হচ্ছে সেন্টার। এই সেন্টার যদি তোমরা দখল নিতে পারো। খেলা অনেকাংশ তোমার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।"
এটা দাবার প্রশিক্ষণের খুবই বেসিক একটা পয়েন্ট। কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ভাবুন একবার। সেন্টার দখলের গুরুত্ব। শুধু দাবা কেন, প্রতিটি জিনিসেরই এমন কিছুনা কিছু পয়েন্ট থাকেই, যা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেই জিনিসটা আমাদের প্রায় দখলে চলে আসে।
আগেরদিনের যুদ্ধের সময় কেল্লা দখল করতো জানপ্রান দিয়ে, এরপরের যুদ্ধগুলোতে রাজধানী দখল করতো।
৭১ সালে পাক হায়েনারা আগে ঢাকায় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ঢাকাকে নিয়ন্ত্রণে নিলো।
হ্যা, আমি আবারো বলছি। প্রতিটি জিনিসেরই এমন কিছুনা কিছু আছে, যা প্রভাবিত করতে পারলে জিনিসটা আপনার নিয়ন্ত্রনে চলে আসবে।
এই সত্য সময়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
(দুই)
সেন্টার দখলের ব্যাপারে বলছিলাম আমি তাজুল ইসলাম মাসুদ। উদ্যোক্তা টাইম ২০২৫।
একটি খুব জনপ্রিয় উক্তি সবাই জানেন, আপনার ভবিষ্যৎ সাফল্য নির্ভর করছে আপনার দৈনন্দিন রুটিনের উপর।
সাফল্যের জন্যে প্রতিটি দিনই গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমরা প্রতিদিন রুটিন অনুযায়ী চলার চেষ্টা করি। রুটিনকে সুন্দর করে সেইঅনুযায়ী চলার জন্যে আমরা গুরুত্বের সাথে ভাবি সময় ব্যবস্থাপনা নিয়ে। টাইম ম্যানেজমেন্ট এর সেন্টার পয়েন্ট হচ্ছে প্রতিদিনের রুটিন। আর প্রতিদিনের সেন্টার পয়েন্ট হচ্ছে সকাল। হ্যা, সকাল। Morning shows the day. Early to bed, early to rise, makes a man healthy wealthy and wise. এই প্রবাদগুলো আমরা এতবার স্কুল জীবনে শুনেছি। কিন্তু এর কার্যকারিতা আমাদের বাস্তব জীবনে দেখা যায়না।
কেন? কারন আমরা এখন #সকালের_পাখি নই, আমরা হয়ে গেছি রাতের পেঁচা। আগে সিঁধেল চোরেরা রাতে চুরি করতো। এখন তাদের রাতে চুরি করার সুযোগ নেই। কারন প্রতিটা ঘরে কেউনাকেউ জেগে আছে। কেউ রাত জেগে ফেসবুকিং করছে, কেউ নেট ব্রাউজিং, কেউ ফোনালাপ, কেউ রেডিও শুনছে অথবা টিভিতে টকশো/গেম দেখছে। কেউবা রাত জেগে বই পড়ছে।
দাবার বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট যেমন মাঝখানের চারটা ঘর। ঠিক তেমনি একটি দিনের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে "সকাল"।
টাইম ম্যানেজমেন্ট এ সফল হবার প্রথম পদক্ষেপ সকালের পাখি হতে হবে, রাতের পেঁচা নয়।
আমি আমার কথাই বলি, আগে আমি রাত জাগতাম। সকাল সাড়ে আটটার কি নয়টার দিকে উঠতাম। পরবর্তীতে বুঝতে পারলাম, আমি ভুল অভ্যাস গড়ে তুলছি। রাতের পেঁচা থেকে নিজেকে সকালের পাখিতে রুপান্তরের চেষ্টায় নামলাম। দুটোতে পার্থক্য আমার আমার কাছে ধরা পড়লো। সাড়ে আটটা অথবা নয়টার দিকে ঘুম থেকে উঠলে, ঝিমুনি ভাব থাকেনা ঠিকই। কিন্তু দিনটা কেমন যেন দ্রুত চলে যায়, নাস্তা খেয়ে সুস্থির হতে না হতেই যেন দুপুরবেলার খাবারের সময় চলে আসে। এরপরে দ্রুত বিকেল আসে, আসে সন্ধ্যা এরপরে রাত। দিনশেষে খুব আফসোস লাগে, "দিনটা দ্রুত চলে গেলো। ধুর তিনভাগের এক ভাগ কাজও তো করতে পারলাম না।"
কিন্তু সকালবেলা ঘুম থেকে উঠলে কি হয়? হ্যা, সকালবেলা ঘুম থেকে উঠলে ঝিমুনি ঝিমুনি ভাব থাকে। কিন্তু সকাল সাড়ে নয়টার মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজই করা যায়।
আবার সকাল দশটা থেকে দুপুরবেলা পর্যন্ত অনেক সময় পাওয়া যায় কাজ করার জন্যে। বিকেলবেলা থেকে রাতে কাজও করা যায়, আবার নিজেকে এবং পরিবারকে সময়ও দেয়া যায়।
মোটকথা সকাল বেলার পাখি হতে পারলে পুরোদিনটা জুড়ে অসাধারণ এক বরকত পাওয়া যায়।
অর্থাৎ বুঝতেই পারছেন সকালবেলা হচ্ছে দিনের সেন্টারপয়েন্ট। যা আপনার দিনকে নিয়ন্ত্রণ করে।
(তিন)
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠলে কি কি উপকার হবে, এসব লিখতে গেলে ইয়ামোটা বই হয়ে যাবে। সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠার উপকারিতা আপনারা স্কুল জীবনে বইতে পড়েছেন। যারা ভুলে গেছেন তারা কি করবেন? গুগলে সার্চ দিয়ে দেখতে পারেন।
এবার আসি কিভাবে দিনটাকে শুরু করবেন।
বেশিনা। মাত্র পাঁচটা সহজ ধাপ ফলো করেই দিনটাকে শুরু করতে পারি।
প্রথম ধাপ: আগেরদিন রাতেই ঠিক করে রাখুন, পরদিন সকালবেলা কটায় উঠবেন। কটা বাজে উঠলে আপনার জন্যে ভালো। এরপরে ঘড়ি অথবা মোবাইলে এলার্ম দিয়ে ঘুমুতে যাবেন।
দ্বিতীয় ধাপ: এমন জায়গায় এমন দুরত্বে এলার্ম ঘড়িটা রাখুন, যাতে সকালে ওটা বন্ধ করতে বিছানা থেকে নেমে, কিছুটা হাটতে হয়।
তৃতীয় ধাপ: সকালে এলার্ম ঘড়ি বন্ধ করে তৃতীয় ধাপে আপনি বাথরুমে যান এবং দাতব্রাশ করুন। চেহারায় পানির ঝাপটা আপনাকে উজ্জীবিত করবে। দাতব্রাশ করার পর পরিষ্কার হলো মুখ। পরিষ্কার মুখ নিয়ে করুন চতুর্থ ধাপ।
চতুর্থ ধাপ: দাতব্রাশ করে এসে কমপক্ষে এক গ্লাস পানি পান করুন খালি পেটে। রাতে আপনি প্রায় আটঘন্টা ঘুমিয়ে ছিলেন, এতসময় আপনার পানি খাওয়া হয়নি। সকালের এই পানি পানকরার মাধ্যমে যে অভাবপূরণ করলেন তা আপনার স্বাস্থ্যের জন্যে অনেক ভালো। সেই সাথে এই অভ্যাস স্কিনেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
পঞ্চম ধাপ: আপনি রাতের ড্রেসটা চেঞ্জ করে ফেলুন। খুবভালো হয় গোসলটা সেরে ড্রেসটা চেঞ্জ করুন।
এই পাঁচটা ধাপ আপনি একমাস চর্চা করে যান। প্রথম দশদিন একটু কষ্ট লাগবে, এরপরের দশদিন কষ্টভাবটা অনেকটা কাটবে। মাসের শেষের দশদিন খেয়াল করবেন এই পাঁচটা ধাপ আপনার অভ্যাসে পরিনত হতে শুরু করেছে।
(চার)
ত্রিশদিন পাঁচটা ধাপ চর্চার মধ্যদিয়ে আপনি পরিনত হলেন সকালের পাখিতে।
এই ত্রিশদিন পর আপনি কি করবেন? আরও এক ঘন্টা আগে উঠবেন। অর্থাৎ এই একমাস যে সময়ে উঠতেন, তারও একঘণ্টা আগে উঠবেন। এই একঘন্টা আগে উঠে কি করবেন?
সেই ব্যাপারে বিস্তারিত লিখবো পরবর্তী পর্ব "সকালের মাস্টার" এ।
----------------
(৮ এপ্রিল, ২০১৮)
Tazul Islam Masud,
Entrepreneur,
Founder of "Time 2025"
#সকালেরপাখি
#টাইম_ম্যানেজমেন্ট
#TimeManagement
#Dhaka
#Bangladesh

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

পথে নামলে পথই পথ দেখায়

মাওলানা ছায়ীদুল হকের আরেকটি পরিচয়

ক্যারিয়ার বান্ধব মেডিটেশন মনছবি