স্বশিক্ষা বনাম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা


(ভূমিকা)

একটি খুব দরকারি এক সত্য প্রকাশের জন্যে আমি আমার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আপনাদের কাছে শেয়ার করছি। আশাকরি এই লেখার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা অথবা মন্তব্য করার আগে পুরো লেখাটাই আপনি পড়বেন। আমার লেখাটা পড়ে অনেকেই হয়তো ভাববেন আমি Robert Kiyosaki এর বই দ্বারা প্রভাবিত। মজার বিষয় হচ্ছে আমি ইংরেজি বই পড়া শুরু করি ২০১৭ এর মাঝামাঝিতে। উনার বই পড়ি ২০১৭ তেই।
কিন্তু এই ঘটনা ২০০৩ সালের।
তবে Rich Dad খ্যাত Robert Kiyosaki উনি খুব দুঃখ প্রকাশ করে একটি কথা বলেছেন। যেই বক্তব্য দিয়েই শেষ ভূমিকা শেষ করছি।
"Today, the most dangerous advice you can give a child is 'Go to school, get good grades and look for a safe secure job.' "

Image result for 80 billionaires have no college degree

(এক)

আমার জীবনের লক্ষ্যই ছিলো ব্যবসায়ী হবার। কিন্তু যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। ওদের সিস্টেমে একেরপর আমার যেন আশাভঙ্গ হতে লাগলো।
আমি মার্কেটিং ম্যানেজমেন্ট, কম্পিউটার সাব্জেক্টও পেলামনা। যাইহোক ব্যাচেলার অব কমার্সে পড়া শুরু করলাম। ওখানে ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা, অর্থনীতি, হিসাব বিজ্ঞানের পাশাপাশি ছিলো বাংলা এবং ইংরেজি।
আমার তিক্ততা বাড়তে শুরু করলো হিসাব বিজ্ঞান নিয়ে। HSC তে আমরা হাই লেভেলের ব্যবসায়ের হিসাব বিজ্ঞানের হিসেব শিখেছি। এখানের অংকগুলো আরোও হাই লেভেলের। এইসব অংক শেখার জন্যে আমাকে অনেক সময় ব্যস্ত থাকতে হতো প্রাইভেট স্যারদের কাছে।
আমি বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম, এই অংক শিখে আমার লাভ কি? এগুলো যে লেভেলের অংক সেই লেভেলের ব্যবসায়ী হতে হলে আমার অন্তত ২০ বছর লাগবে। ততদিনে নিশ্চয়ই এই অংক মনে থাকবেনা। আর ততদিনে এই অংকের ফরমেট চেঞ্জ হয়ে যেতে পারে। আর তা না হলেও এই হিসাবরক্ষনের অংক শেখার দরকারটাকি? এক্সেল সফটওয়্যার এর মাধ্যেমে কাউকে দিয়ে টেবিল সেট করিয়ে নেব। এরপর ডিজিট বসালেই এক্সেল নিজেই হিসাবরক্ষনের কাজ করবে। আমরা প্রিন্ট আউট করে নেব। সহজ হিসাব।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি আস্থা হারাতে লাগলাম। আবার আমাদের বাংলা পড়তে হতো। সেখানে রবীদ্রনাথ ঠাকুরের গল্পের একটি চরিত্র। খুব সম্ভবত হৈমন্তি, না জানি অন্য কেউ হবে। ধরে নিচ্ছি "হৈমন্তি "। প্রশ্ন আসলো, হৈমন্তির চরিত্র বিশ্লেষণ করো। আমার গেলো মেজাজ বিগড়ে, আমি লিখতে গিয়েও লিখলাম না, "হৈমন্তির চরিত্র আমি কেন বিশ্লেষণ করবো, হৈমন্তি কি আমার বিয়ে করা বউ?" ভাগ্যিস লিখিনি। এরপর ছিলো কবিতা। কবিতা আর ভাষা চর্চা এগুলো আমি কম বুঝি তাই এড়িয়ে চলতাম। এখনও চলি।

(দুই)

আমি সিদ্ধান্ত নেই, আমি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করবো না। কিন্তু শিক্ষা অর্জন করবো নিজস্ব সিলেবাসে। এটা সম্ভবত ২০০৩ এর ঘটনা। তখন গুগল আমার নাগালে ছিলোনা। সদরঘাটের পুরানো বইয়ের দোকানগুলোই ছিলো আমার গুগল। আমি সদরঘাট গিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এর সিলেবাস কিনলাম। কারন সিলেবাসে অনেক রেফারেন্স বইয়ের নাম থাকে,কোন প্রকাশনীর বই সেই প্রকাশনীর নামও থাকে।
আমি সিলেবাস ঘেটে নিজের জন্যে সিলেবাস করলাম।
আমার চ্যাপ্টার হবে ৫ টা।
১) অর্থনীতি।
আমি বিশ্বাস করতাম, একজন গায়ক এর জন্যে যেমন সারেগামা। একজন ব্যবসায়ীর জন্যে অর্থনীতি।
২)ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা এবং অফিস ব্যবস্থাপনা।
৩)মার্কেটিং ব্যবস্থাপনা
৪) অর্থায়ন ব্যবস্থাপনা
৫)শিল্প মনোবিজ্ঞান।
চ্যাপ্টার ঠিক করার পর সেই সিলেবাস দেখে ঠিক করলাম, কোন কোন বই কিনবো।
আমরা ক্লাসে সব বই একসাথে পড়ি। যেমন এখন এটা বিকেলে ওটা।
কিন্তু এখানে আমি ঠিক করলাম, আগে একটা বই কমপ্লিট করবো, এরপর অন্য বই ধরবো।
প্রথমেই কিনলাম, নামকরা অর্থনীতি মোটা একটি বই। যেখানে ম্যাইক্রো এবং ম্যাক্রো ইকোনোমিক্স ডিটেইলস দেয়া আছে।
কয়েক মাস পড়ে রইলাম অর্থনীতি নিয়ে। অর্থনীতিকে যতটা কঠিন মনে হয়, আসলে এটা অতটা কঠিন না। অর্থনীতিতে একটি চ্যাপ্টার আছে। যদি কেউ সেই চ্যাপ্টারটা কে ধরতে পারে, অর্থনীতি তার সাথে কথা বলবে।
অর্থনীতি শেষ পর আমি একের পর এক এভাবে বই কিনে শেষ করতে লাগলাম Management এরপর Marketing এরপর Financial Management এরপর অন্যান্য বিষয়।
এভাবে কেটে গেল আমার প্রায় দুটো বছর।

(তিন)

এবার আসি আমার এই পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে, সেটা হচ্ছে "গোপনীয়তা"।
আমি প্রায় দুবছর এভাবে নিজে নিজে জ্ঞান অর্জন করবো, এটা যদি ঘরে বাইরের লোক জানে, কি হতো? আমার পক্ষে এই দুবছর এভাবে পড়াশুনা অনেক অনেক অনেক কঠিন হয়ে যেত। তখন হয়তো সবাই টিটকারি দিত, হাসাহাসি করতো। সবচেয়ে বড় বিষয় আমি ফ্যামিলি সাপোর্ট পেতাম না। যদি ফ্যামিলি এটা মেনেও নিত, তাও আমার সমস্যা হতো। হয়তো যখন তখন বলতো, যা দোকান থেকে এই এই সদায় নিয়ে আয়, অথবা তোর বোনটাকে স্কুল থেকে নিয়ে আয়। এরকম হলে আমার পক্ষে পড়ায় মনোযোগ রাখাটা কঠিন হয়ে যেত। যেহেতু আমার এই সিলেবাসে কোনও শিক্ষক ছিলোনা, পুরো বিষয়টা নিজেকেই বুঝে নিতে হচ্ছে, তাই এখানে মনোযোগটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। যাই হোক বিষয়টা গোপন থাকার কারনে ফ্যামিলির মানুষ আমাকে নিরিবিলি ছেড়ে দিত, "ঠিক আছে বাবা তুই পড়, পরীক্ষার প্রস্তুতি নে!"
তবে মহল্লার এক বড় আপু কিভাবে কিভাবে যেন বিষয়টা জেনে গিয়েছিলো। আমাকে একদিন রাস্তায় দেখে বললো, "হা মাসুদ তুমি তো এখন মাস্টার্স এর বই পড়ছো।" (অবশ্য Business Finance & Financial Management এবং Business Management & Strategy, Office Management এই বইগুলো মাস্টার্সে পড়ানো হতো।)
আপুর কথা শুনে হাসতাম। আর ভাবতাম, "জানলো ক্যামনে?"
এভাবে প্রায় দুই বছরে কমপ্লিট করলাম আমার নিজস্ব সিলেবাস।
কমপ্লিট করার আগে বুঝিনি। কমপ্লিট করার পড়ে বুঝলাম, আমি ১০০% সঠিক কাজটাই করেছি।
আমি যদি প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার হাতে নিজেকে ছেড়ে দিতাম, কি হতো? লাখ লাখ টাকা খরচ করে গ্রাজুয়েট হতাম, মাস্টার্স কমপ্লিট করতাম, এরপর চাকুরীর জন্যে উমুক দেশের প্রেসিডেন্ট এর নাম কি? তমুক রাজধানী কবে হইছে? এইসব অপ্রয়োজনীয় আবর্জনা মুখস্ত করতে হতো।
আর আমি যে জ্ঞান অর্জন করলাম, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় এর ৫% অর্জন আমি অর্জন করতে পারতাম না। কারন বইতে যা থাকে, সিলেবাসে দেয়া হয় তার ১০%। এছাড়া সাজেশন টাজেশন এ কমে অর্ধেক। অর্থাৎ সেই বইয়ের ৫% আমাকে পড়তে হতো। পরীক্ষার টেনশনতো আছেই।
আমি যদি এভাবে সিলেবাস কমপ্লিট না করতাম। আমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানই অপুর্ণ থাকতো। এভাবে না পড়লে Business Finance & Financial Management এভাবে পড়াই হতো না, তাই এই সাব্জেক্টের অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আমার অজানা থাকত, যেমন Time value of money, Risk Management, এছাড়া নগদ প্রবাহের ব্যবস্থাপনার অনেক সহজ টেকনিক আমার অজানা থাকত।
আমি একটা জায়গায় অন্যদের চেয়ে এগিয়ে, সেটা হচ্ছে আর্থিক ব্যবস্থাপনা। আমি যদি এভাবে ফিনান্স না পড়তাম, অর্থনীতি না পড়তাম, আমি এই অংশে দুর্বল থাকতাম।
এছাড়া Management Strategy থেকে আমি বেশ কিছু কৌশল পেয়েছি, যা আমাকে পরিকল্পনা তৈরিতে সহযোগীতা করে।
Marketing Management শেখা যায় বাস্তবে কাজ করে, ফিল্ডে কাজ করে। যা আমি করেছি। তবে এই আমার এই সিলেবাসের মাধ্যেমে ফিলিপ কাটলারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেয়েছি, যা আমার মার্কেটিং কে কিছুটা সহজ করে দিয়েছে।
এই সিলেবাস এভাবে কমপ্লিট করার পর আমি জানতে পারলাম, অনেক বিলিওনিয়াররাও নাকি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এড়িয়ে গেছেন।
স্টিভ জবস এর ড্রপ আউট অর্থাৎ গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট না করাটা যে ঐতিহাসিক এটা এখন আমরা সবাই জানি।
তবে বিল গেটস ড্রপ আউট এটা আমি ২০০০ সালে জেনেছি। এমনও হতে পারে, বিল গেটসের এই ড্রপ আউটের চিন্তাটা অবচেতন ভাবেই আমি ফলো করে গিয়েছি।
আমি আমার ভবিষ্যৎ সন্তানকে উৎসাহ দেব, আন্ডারগ্রাজুয়েট থাকার জন্যে।
কারন কাগজের সার্টিফিকেট এর জন্যে বছরের পর পর এভাবে সময় এবং মেধা নস্ট করার কোনও মানেই হয়না।
তবে সে যদি সচিব হতে চায়, তাহলে গ্রাজুয়েট হোক। তবে আমার বিশ্বাস আমার সন্তান উদ্যেক্তাই হতে চাইবে। কারন তার বাবা এবং দাদা ব্যবসায়ী ছিলো।
দোয়া করুন যেন বিশ্ব শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন আসে।
এতক্ষন মনোযোগ দিয়ে এই লেখাটা পড়ার জন্যে আপনাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ।
---------------------------
তাজুল ইসলাম মাসুদ,
৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭,
বৃহস্পতিবার,
ঢাকা, বাংলাদেশ।

Comments

Popular posts from this blog

পথে নামলে পথই পথ দেখায়

মাওলানা ছায়ীদুল হকের আরেকটি পরিচয়

ক্যারিয়ার বান্ধব মেডিটেশন মনছবি